হেলথ ইনফো ডেস্ক :
দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ স্ট্রোক, আঘাতজনিত অক্ষমতা, বয়স্কদের চলাচলজনিত সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধিতায় ভোগেন। নানা অসুস্থতা ও দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এসব রোগীদের জন্য ওষুধ বা অস্ত্রোপচারই যথেষ্ট নয়, বরং তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন (পিএমএন্ডআর) অপরিহার্য। এক্ষেত্রে নতুন শক্তি, নতুন দক্ষতা ও আশার আলো দেখান এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
জাতীয় ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন দিবসে আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সকালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব কথা তুলে ধরা হয়।
সমন্বিত পুনর্বাসনে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা—এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের (বিএসপিএমআর) সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো তসলিম উদ্দিন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এম এ শাকুরসহ আরো অনেকে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ‘বর্তমানে স্ট্রোক, দুর্ঘটনা, আর্থ্রাইটিস ও স্পাইনাল ইনজুরিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে ওষুধ বা অস্ত্রোপচারই যথেষ্ট নয়—রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন অপরিহার্য।’
তারা বলেন, পিএমএন্ডআর হলো এমন একটি চিকিৎসা শাখা, যা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, ব্যথা, পেশী ও স্নায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করে। এটি শুধু চিকিৎসা নয়, বরং জীবন পুনরুদ্ধারের চিকিৎসা।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ স্ট্রোক, আঘাতজনিত অক্ষমতা, দুর্ঘটনা, পেশী সন্ধি ব্যথা, শিশুদের সেরিব্রাল পালসি, বয়স্কদের চলাচলজনিত সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধিতায় ভোগেন। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, আধুনিক ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) বরাত দিয়ে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০২২ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংখ্যা আনুমানিক তেতাল্লিশ লাখ ত্রিশ হাজার ৭১০ জন এবং প্রতি হাজারে ২৫.৫ জন প্রতিবন্ধিতায় ভোগেন।
বক্তারা বলেন, প্রতিবন্ধীদের সেবা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন—যথাযথ তথ্যের ঘাটতি, পুনর্বাসন সেবার সীমাবদ্ধতা। এ ছাড়া গ্রামীণ এলাকায় প্রতিবন্ধীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় বার্ধক্যজনিত সমস্যাও ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০২০ সালের একটি প্রকাশিত নিবন্ধ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের সংখ্যা প্রায় ৯.৮%।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের অংশ ছিল ৭.৭% এবং ২০২৩ সালে ৯.৫%, যা ২০২০ থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ এই বয়সীদের অংশ প্রায় তিন গুণ বাড়বে। ফলে বয়স্কদের শারীরিক অক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ ও পুনর্বাসনের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যাবে। প্রতিবন্ধিতা ও অক্ষমতা বৃদ্ধিপ্রবণ, বয়স বাড়ার সঙ্গে শারীরিক অক্ষমতার (mobility issues তথা শ্রবণ ও দৃষ্টির সমস্যা, হাড়-পেশি দুর্বলতা) প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। প্রতিবন্ধীদের সেবা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহের মাঝে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেবার ঘাটতি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ ও থেরাপিস্টের সীমাবদ্ধতা, পুনর্বাসন অবকাঠামো ও সহায়ক প্রযুক্তির স্বল্পতা, প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত তথ্য ও পরিসংখ্যানের ঘাটতি, সামাজিক মনোভাব ও সচেতনতার অভাব।
সোসাইটির সহ সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ শাকুর বলেন, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ইতোমধ্যে দেশের প্রথম রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার স্থাপন করেছি—যা পুনর্বাসন চিকিৎসায় প্রযুক্তির এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। আধুনিক রোবোটিক থেরাপির মাধ্যমে রোগীরা আরও দ্রুত ও কার্যকরভাবে সুস্থ হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের এই উদ্যোগ সমাজে সচেতনতা বাড়বে এবং পুনর্বাসন চিকিৎসায় সরকার, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরও জোরদার করবে।’
অনুষ্ঠানে ফিজিক্যাল মেডিসিন এবং রিহ্যাবিলিটনের উপর গুরুত্ব দিয়ে অন্যান্য বক্তারা বলেন, দেশের পুনর্বাসন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে চিকিৎসক, থেরাপিস্ট, নার্স, মনোবিজ্ঞানী ও পরিবারের সদস্যদের সমন্বিত ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।
তারা জানান, দুর্ঘটনা বা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত অনেক মানুষ সঠিক পুনর্বাসন না পাওয়ায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। তাই প্রতিটি মেডিকেল কলেজে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ ও আধুনিক থেরাপি সুবিধা বাড়াতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চিকিৎসক সমাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্রিকেট খেলি—আপনারা দেখেন রান করছি, ইউকেট পাচ্ছি। কিন্তু আপনারা যে কত হাজার হাজার রান করেন, আপনাদের রানটা যদি গণনা করা হতো …, দুর্ভাগ্যবশ আপনাদের রান গণন করা হয় না। একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য আপনাদের যে অবদান, কঠোর পরিশ্রম, গবেষণা—এর কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।’
ক্রিকেট খেলতে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট খেলতে চারটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা হয় তো দেখি কীভাবে ব্যাট ধরে, কীভাবে বল করে, কীভাবে ক্যাচ ধরে? এইগুলো করতে গেলে চারটি জিসিন লাগে। এটা হলো টেকনিকেল, আরেকটি ট্যাকটিক্যাল। আর হাই পারফরমেন্সের জন্য যে দুটি জিনিস জরুরি, তা হলো—ফিজিক্যাল ও মেন্টাল। যেই দলগুলো র্যাংকিংয়ের অনেক উপরে, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বা পিছিয়ে থাকা দলগুলোর বড় পার্থক্য হলো ফিজিক্যাল ও মেন্টাল। ক্রিকেট দিন দিন ফাস্ট হয়ে যাচ্ছে, যেখানে ফিজিক্যাল চাহিদা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টেস্ট ক্রিকেটটা দেখতে স্লো হলেও এখানে কনসিসট্যান্স ফিটনেস খুব জরুরি। এজন্য আমরা আপনাদের সাহায্য চাই। সন্তোষজনক পর্যায়ে যেতে চাইলে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও ভালো করতে চাইলে—ফিজিক্যাল ও মেন্টাল দিকটি অত্যন্ত জরুরি। এজন্য আপনাদের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে চাই।’
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো তসলিম উদ্দিন সোসাইটির সকল সদস্য এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আগত অতিথিদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘আপনাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও সহযোগিতাই আমাদের এই প্রচেষ্টার প্রেরণা। আমরা বিশ্বাস করি—সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও মানবিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবসময় মনে করি, ডিজএবিলিটি মানেই ডিজএবল নয়। এটি আসলে ডিফারেন্ট এবিলিটি। এসব রোগীদের সীমাবদ্ধতার পাশে কিছু সক্ষমতা যোগ করা গেলে তাদের অক্ষমতা অনেকাংশেই কমে আসে। ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন সেই সক্ষমতাই তৈরি করে মানুষকে নতুন শক্তি, নতুন দক্ষতা ও নতুন আশার আলো দেয়।’
বিএসপিএমআরের জেনারেল সেক্রেটারি ডা. এ কে আজাদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তারা ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশনের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেন। তারা বলেন, দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এখানে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রিহ্যাবিলিটেশন জনবল নিয়োগ দেওয়া হোক এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক, যাতে মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে।
বক্তারা বলেন, বিদ্যমান আইন কার্যকর করা হোক, নতুন আইন প্রণয়ন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে তৎপরতা বাড়ানো হোক। সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, এসএনজিও ও সিভিল সোসাইটি একসঙ্গে কাজ করে পুনর্বাসন চিকিৎসা ও সুবিধার মানোন্নয়নে সম্মিলিত উদ্যোগ নিক। পাশাপাশি তারা স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র, সড়ক ও পরিবহনসহ সর্বত্র প্রতিবন্ধিবান্ধব ইউনিভার্সাল ডিজাইনের মান মেনে পরিবেশ তৈরি করার গুরুত্বও তুলে ধরেন তারা।
এর আগে সকালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা প্রাঙ্গণে একটি বর্ণাঢ্য র্যালির মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়। র্যালির উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার।