Take a fresh look at your lifestyle.

‘মেধাশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে স্বাস্থ্যখাত’

১২২

বরিশাল হেলথ ইনফো ডেস্ক
বেতন বৈষম্য, ন্যূনতম মানদণ্ডের অভাব এবং সামাজিক সুরক্ষার কারণে স্বাস্থ্য খাতে মেধাবী ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে। একই সঙ্গে বড় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে। এ কারণে বিদেশে মাইগ্রেশনের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ খাতে মেধাবীদের আসা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

আজ মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে সিরডাপ অডিটোরিয়ামে ‘স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি জনবলের বেতন নীতি: বর্তমান বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ’ শীর্ষক আলোচনায় এসব কথা বলা হয়।

অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস, বাংলাদেশের (এএইচআরবি) আয়োজনে অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ. কে. আজাদ খান। উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পে কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক, শ্রম স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. খালেদা হানুম আক্তার, জন প্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. শাহিনা সোবহান মিতু, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব মহাসচিব ডা. মো. জহিরুল ইসলাম শাকিল, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) হেলথ উইংয়ের যুগ্ম মূখ্য সমন্বয়ক ডা. মো. আব্দুল আহাদ, নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভানেত্রী জাহানারা বেগম, মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি ডা. মোস্তাক রহিম স্বপন, মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. আনোয়ারুল ইসলাম ও নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার হালিমা আক্তার।

অধ্যাপক ডা. এ. কে. আজাদ খান বলেন, ‘বেতন কাঠামোর পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগগুলোও তার প্রাপ্য। কিন্তু আমরা আলাপ করার সময় তা ভুলে যাই। যেমন—সে বাড়ি পেল কি-না, গাড়ি পেল কি-না, যাতায়াত সুবিধা পেল কি-না, দারোয়ান পেল কিনা—এটা আলোচনার করার বিষয়। তা না হলে তুলনা করা মুশকিল।’

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন বেতনে জীবন নির্বাহ করতে পারেন, এদিকে খেয়াল করতে হবে। তা না হলে মানুষ চলতে পারবে না। স্বাস্থ্যখাতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীও আছে। তার বেতনের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। ইমার্জেন্সিসহ বিভিন্ন পরিবেশে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করেন, তাদের ঝুঁকি ভাতা নিয়েও ভাবতে হবে।

এ সময় স্বাস্থ্যখাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আহ্বান জানান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ. কে. আজাদ খান। তিনি বলেন, ‘একজন সিভিল সার্জনকে যে বেতন দেওয়া দরকার, তা দেওয়া হয় না। তাদের ব্যবস্থাপনা জ্ঞান রয়েছে। এই জ্ঞান থাকলে তার প্রাপ্য অনেক বেশি। এখন তাঁকে যা দেওয়া হচ্ছে, মূলত তার চেয়ে বেশি দেওয়া হয়। বেতনের মাধ্যমে না, টেবিলের নিচ দিয়ে। মিন্টো রোডের একটি বাড়ির ভাড়া কত? কয়টা গাড়ি তিনি করেছেন? … সুতরাং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাইলে এটা ভাবতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, ‘আমি নতুন বেতন কাঠামোকে একটু তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চাই। এর দার্শনিক দৃষ্টিকোণও আছে। সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন এমন হওয়া উচিত, যেন সেই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের পর উপার্জনের জন্য তাকে অন্য কোথাও আত্মনিয়োগ করতে না হয়। কারণ তাতে আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা ও প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো করে দেখার বিষয়টি অনেকাংশ নষ্ট হয়ে যায়। সমাজে আসলে অহরহ সেটাই হচ্ছে। এ বিষয়টি একটি মৌলিক দর্শন হিসেবে নিতেই হবে।’

‘এর সাথে কতগুলো তথ্য দেবো, যেগুলো ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করেছি। এর যথার্থতা ড. হামিদ ভালো করে বলতে পারবেন। ২০১৪ সালে যে গড় পণ্যমূল্য ছিল, ২০২৫ সালে তার চেয়ে ২.১ গুণ বেড়েছে। তার মানে আমাদের খরচ অতটা বেড়েছে। এখন যদি আমরা মনে করি, আমার কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে পূর্ণ স্বাচ্ছন্যটা দিতে চাই, এর চেয়ে বেশি না। তাহলে বেতন ২.১ গুণ বাড়াতে হবে। আবার অন্যদিকে যদি চিন্তা করি, সরকারের কী সেই সক্ষমতা আছে? তাহলে বলবো, আমাদের জিডিপি ২০১৪ সালে যা ছিল, ২৯২৪-২৫ সালে তার তুলনায় ২.৭ গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ পণ্যমূল্য যা বেড়েছে জিডিপি তার চেয়ে বেশি। তার অর্থ হলো, আমরা তাত্ত্বিকভাবে নিতে পারি যে, সরকারের সক্ষমতা বেড়েছে। যদিও এটা একেবারে নিখুঁত আমরা তা বলতে পারবো না। কারণ আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি তার বিতরণটা হয়েছে চূড়ান্তভাবে অসম’—যোগ করেন ডা. আতিক।

তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটি বিষয় আছে, সরকারের রাজস্ব আয় কত বেড়েছে? ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের সাথে ২০১৮-১৯ তুলনা করলে দেখবো, এই সময়ে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১.৭ গুন। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে আয় ছিল খুব ব্যতিক্রমধর্মী। যেটাকে আমরা বলি, বৃত্তের বাইরে চলে যাওয়া। এই সময় প্রায় ২৬১ গুণ বেড়েছে। যদিও সেটা আবার ভবিষ্যতে হবে, তা আমি মনে করি না। কিন্তু আমরা এটা বলতে পারি যে, আমাদের প্রস্তাবিত নতুন যে বেতন কাঠামোটা হবে, তার সুপারিশ কার্যকর হতে ২০২৬-২৭ পর্যন্ত চলে যাবে। প্রজেকশন হলো, এই সময়ে ২০১৪-১৫ এর তুলনায় সরকারের রাজস্ব আয়, যদিও তা অপ্রতুলই থাকবে, কারণ সরকারের প্রয়োজনের তুলনায় এ আয় অনেক কম এবং আমাদের কর আদায়ও নিয়োজিতদের দক্ষতার তুলনায় অনেক কম। তবুও পাঁচগুন বাড়বে। ২০২৫-২৬ সালে সরকারের মোট রাজস্ব আয় নয় হাজার ৩৩০ বিলিয়ন টাকার চেয়ে বেশি হবে, কম হবে না।’

‘তাহলে ন্যূনতম স্বচ্ছলতার বিষয়টি আমরা কীভাবে নিশ্চিত করবো। সরকারি কাঠামোতে ২০তম গ্রেড আর বেসরকারি কাঠামোতে ক্লিনার—তাদের কথা যদি চিন্তা করি চার সদস্যের পরিবার হিসেবে। চার সদস্যের একটি সংসার ন্যূনতম খরচে চালতে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহর আর উপকণ্ঠে পরিবারের উপার্জন হতে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। ঢাকা আর এর উপকণ্ঠে ৩৭ হাজার পাঁচশ’ টাকা হতে হবে। এটা আমাদের মাথায় আছে’—বলেন পে কমিশনের এই সদস্য।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্য এবং ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কনভেনশন ১৩১ এর নির্দেশনা আংশিকভাবে মানে। তবে স্বাস্থ্যখাতের মতো পেশাগত খাতে জীবন যাত্রার মান, প্রোডাক্টিভিটি কাঠামো পুরোপুরি কার্যকর নয়। পেশাভিত্তিক জব ইভালুয়েশন, পারফর্মেন্স বেইজ পে চালু করলে আইএলও সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।’

অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যখাতে বর্তমানে সমস্যা সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতন কাঠামোর বৈষম্য। এখানে বেতন কাঠামো মূলত পদমর্যাদা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। বাস্তব জীবনযাত্রার ব্যয়, উৎপাদনশীলতা ও পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে এর সামঞ্জস্য নেই। নৈশকালীন দায়িত্বপালন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের অতিরিক্ত পারিশ্রমিক নেই। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করেছি, বেসরকারি খাতে বেতন পেতে বিলম্ব হয়। একই কাজ হলেও বেতন বৈষম্য, ন্যূনতম মানদণ্ডের অভাবের পাশাপাশি সামাজি সুরক্ষাও নেই। এতে মেধাবী ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এসব খাতে মেধাবী এই সমস্ত খাতে মেধাবী লোকদের আসার পরিমাণ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

বেসরকারি খাতের সঙ্গে বেসরকারি খাতের একটি বড় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব কারণে বিদেশে মাইগ্রেশনের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি জনবল দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান প্রক্রিয়ার অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ কাঠামোতে দীর্ঘদিন ধরে যথাযথ বেতন কাঠামো, নীতি-অসামঞ্জস্য এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নানা জটিলতা বিদ্যমান। সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন কাঠামোতে বিদ্যমান অসামঞ্জস্যতা কেবল কর্মপ্রেরণা ও দক্ষতা নয়, বরং সেবার গুণগত মানেও প্রভাব ফেলছে।

সভায় স্বাস্থ্য খাতের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বা পে কমিশনের দাবি জানান বক্তারা।
সূত্র : মেডিভয়েস

Leave A Reply

Your email address will not be published.