Take a fresh look at your lifestyle.

ভয়ংকর ছত্রাক আইসিইউতে

দেশে আইসিডিডিআর,বির প্রথম গবেষণা

30

বরিশাল হেলথ ইনফো ডেস্ক :
রাজধানীর একটি হাসপাতালে সুস্থ ফুটফুটে সন্তান প্রসব করেন এক মা। মায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয় নবজাতককে। আর এই হাসপাতালে থাকাটাই কাল হয়েছে নবজাতকের জন্য। ছত্রাকের ভয়ংকর সংক্রমণে জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে নিভে গেল নবজাতকের জীবনপ্রদীপ।

নানা পদক্ষেপের প্রাণান্ত চেষ্টায়ও বাঁচাতে পারলেন না চিকিৎসকরা। কারণ, হাসপাতালের শয্যা থেকে যে ছত্রাকের এমন ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটতে পারে, সে বিষয়টি ছিল সবার অজানা। এমনকি দেশের হাসপাতালগুলোয় ছত্রাক সংক্রমণ নির্ণয়ের ব্যবস্থাও নেই। এই সংক্রমণের হার নিবিড় পরিচর্যায় সবচেয়ে বেশি, যা নিবিড় পরিচর্যায় থাকা রোগীদের মৃত্যুর অন্যতম অনুষঙ্গ।

আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) একদল গবেষক দেশে প্রথমবারের মতো হাসপাতালভিত্তিক আক্রমণাত্মক ছত্রাক সংক্রমণের ওপর নজরদারি চালাচ্ছেন। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ঢাকার দুটি টারশিয়ারি হাসপাতালের (বৃহৎ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল) ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে চলছে এই নজরদারি।

যার অংশ হিসেবে ছত্রাক সংক্রমণে সংবেদনশীল কেস হিসেবে চিহ্নিত ৯৯২ জন রোগীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এসব অনুসন্ধান নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র, বিশেষ করে ঢাকার দুটি টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে প্রাপ্তবয়স্ক, নবজাতক এবং শিশু রোগীদের মধ্যে প্রাণহানিকর ছত্রাক সংক্রমণের উচ্চ হার প্রকাশ করে।

আইসিইউতে ভয়ংকর ছত্রাক
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সিস্টেমিক ছত্রাক সংক্রমণের ক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারি ব্যবস্থা না থাকায় এর আগে এ ধরনের প্রাণসংহারী ছত্রাক চিহ্নিত হয়নি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ছত্রাক সংক্রমণের উচ্চঝুঁকি শনাক্ত এবং ক্যান্ডিডা অরিস ও ক্যান্ডিডা ব্ল্যাঙ্কি নামের দুটি ছত্রাক হয়ে উঠেছে ওষুধ প্রতিরোধী।

বিশেষ করে ছত্রাক প্রতিরোধী ওষুধ ফ্লুকোনাজোল, ভোরিকোনাজোল প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। তবে ক্যাসপোফাঙ্গিন, মাইকাফাঙ্গিন ইত্যাদি ওষুধগুলো কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। যদিও এই ওষুধগুলো সহজলভ্য নয় এবং ব্যয়বহুল।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, দেশে ছত্রাকের সংক্রমণে বছরে প্রায় ৩০ হাজার ১৭৮ জন দীর্ঘস্থায়ী পালমোনারি অ্যাসপারগিলোসিসে (শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া) আক্রান্ত হয়ে থাকেন; যাদের ৮০ শতাংশই যক্ষ্মা রোগী। ৯০ হাজার ২৬২ জন অ্যালার্জিক ব্রঙ্কপালমোনারি অ্যাসপারগিলোসিসে সংক্রমিত হন। ৮ হাজার ১০০ জন ক্যান্ডিডা ছত্রাকের মাধ্যমে রক্তপ্রবাহ সংক্রমণের শিকার হয়ে থাকে; এই হার প্রতি লাখে পাঁচজন।

এ ছাড়া ৫ হাজার ১৬৬ জন আক্রমণাত্মক অ্যাসপারগিলোসিস সংক্রমণের শিকার হন। যারা মূলত ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণ এবং ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে ছত্রাক সংক্রমণের প্রধান কারণ ক্যান্ডিডা ব্লাঙ্কি, যা মোট সংক্রমণের ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

ছত্রাক সংক্রমণের বৈশ্বিক চিত্রও বেশ ভয়াবহ। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় সাড়ে ছয় মিলিয়ন বা ৬৫ লাখ মানুষ ছত্রাক সংক্রমণের শিকার হন। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন বা ৩৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় ছত্রাকজনিত সংক্রমণে। মৃতদের মধ্যে আড়াই মিলিয়ন বা ২৫ লাখ মানুষের মৃত্যু শুধু ছত্রাক সংক্রমণের কারণেই ঘটে।

গবেষকরা বলছেন, এই ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে মাইক্রোবায়োলজিক্যাল প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, যেসব ওষুধ এখনো কাজ করছে, সেগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কার্যকারিতা হারাবে। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, তা না হলে অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকির কারণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের তুলনায় ছত্রাক সংক্রমণ প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। সময়মতো শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা না করলে, এই সংক্রমণগুলো দ্রত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। ওষুধ প্রতিরোধী ছত্রাক একটি উদীয়মান বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য হুমকি, যা সম্প্রতি বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোয় সেবা নেওয়া রোগীদের মধ্যে রক্তপ্রবাহে ছত্রাক সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ সংক্রমণগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয় বা দেরিতে শনাক্ত হয়। ফলে প্রতিরোধযোগ্য সংক্রমণের কারণে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে।

গবেষণায় ক্যান্ডিডা অরিস এবং ক্যান্ডিডা ব্লাঙ্কির মতো ভয়ংকর ছত্রাকও শনাক্ত হয়েছে। ক্যান্ডিডা অরিস রক্তপ্রবাহের সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার ৮০ থেকে ১০০ শতাংশে পৌঁছেছে। গবেষকরা বলেছেন, এ ধরনের সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং শক্তিশালী সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জীবন বাঁচাতে পারে। এই ছত্রাকগুলোর ওপর ফ্লুকোনাজোলের মতো সাধারণ অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধগুলো কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। তবে মাইকাফাঙ্গিন এবং ক্যাস্পোফাঙ্গিনের মতো কিছু ব্যয়বহুল দুষ্প্রাপ্য ওষুধ এখনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

এ প্রসঙ্গে এই গবেষণার প্রধান গবেষক আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর ড. তানজির আহমেদ শুভ বলেন, ‘দেশে এর আগে ছত্রাকের সংক্রমণ ও ইনফেকশন নিয়ে কোনো গবেষণা ছিল না। তাই ছত্রাক সংক্রমণের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল না। আমরা গবেষণায় দেখতে পেলাম ব্যাকটেরিয়ার মতো ছত্রাকও ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। সাধারণ ওষুধ এবং জীবাণুনাশক এসব ছাত্রাকের বিরুদ্ধে যথেষ্ট স্বক্রিয় নেই। এক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। অন্যথায় ছত্রাক সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।’

ছত্রাক হল একটি বহুকোষী অণুজীব, যা মানুষ, প্রাণী এবং উদ্ভিদের মধ্যে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। ছত্রাক সাধারণত পৃষ্ঠস্থ সংক্রমণ, মুখের থ্রাশ, রিং ওয়ার্ম সংক্রমণ ঘটায় এবং অনাইকোমাইকোসিস ইত্যাদি ভাবে ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে। সাধারণত আক্রমণাত্মক বা সিস্টেমিক ছত্রাক সংক্রমণ; ক্রিপ্টোকক্কাল মেনিনজাইটিস; দীর্ঘস্থায়ী পালমোনারি অ্যাসপারগিলোসিস; নিউমোসিস্টিস নিউমোনিয়া ইত্যাদি ছত্রাকের প্রধান সংক্রমণ।
সূত্র : কালবেলা

Leave A Reply

Your email address will not be published.