জাকিয়া আহমেদ :
১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৫৭ মিনিটে ঢাকার গ্রিন রোডের বেসরকারি গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয় আজিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে। এক ঘণ্টা পর রাত ৯টা ২ মিনিটে আইসিইউতে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপরই চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলেন আজিজুর রহমানের ছেলে সাজিদ হাসান।
কলাবাগান থানায় মামলা করেন পরিবারের পক্ষ থেকে মো. সুমন নামের একজন। সে মামলায় আজিজুর রহমানকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া ডা. সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রিন লাইফ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাপের মুখে কোনও তদন্ত ছাড়াই ডা. সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
প্রথমে মামলাটি হয়েছিল ১৭ জনের বিরুদ্ধে। যেখানে গ্রিন লাইফের কর্তাব্যক্তিরাও ছিলেন আসামি। কিন্তু ঘটনার পরিক্রমায় এজাহার পরিবর্তনে এখন আসামি রাখা হয়েছে কেবল ডা. সজীব নজরুলকে। আর তারপরই তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মামলাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন কোনও ধরনের চাপ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। শুধু ডা. সজীবকে আসামি করা নিয়ে তিনি বলেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করবেন তিনি।
এদিকে যথাযথ তদন্ত ছাড়াই শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে একজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করায় ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন না হওয়ায় এই ধরনের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা আবার স্পষ্ট হলো।
কী হয়েছিল সেদিন
গ্রিন লাইফ হাসপাতালের নথিপত্রে দেখা যায়, ৫৮ বছরের আজিজুর রহমানকে ১৬ ডিসেম্বর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়েছিল ৭টা ৫৭ মিনিটে। তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সজীব নজরুল তাকে দেখতে শুরু করেন ৭টা ৫৯ মিনিটে। অর্থাৎ আনার দুই মিনিট পর। তখন আজিজুরের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ছিল ৮৭। তাকে তখন অক্সিজেন দেওয়া হয়, করানো হয় ইসিজি।
জরুরি বিভাগ থেকে দেওয়া আজিজুরের ব্যবস্থাপত্রে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, সিকেডি (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ), হৃদরোগের কথা উল্লেখ আছে।
এই হাসপাতালেই তিনি এর আগেও দুবার আইসিইউতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এবার আইসিইউতে নিতে দেরি করায় তার মৃত্যু হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ।
কতটা দেরি হয়েছিল কিংবা কেন দেরি হয়েছিল- জানতে চাইলে সেখানে কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “তাকে তো আগে জরুরিভাবে ইভ্যালুয়েট করতে হবে। কোমর্বিড (অন্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হয়ে ঝুঁকিতে থাকা) রোগী, সেজন্য তার প্রিভিয়াস হিস্ট্রি নিতে হবে। নয়ত তাকে সিসিইউ নাকি আইসিইউতে পাঠানো হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না।”
কার্ডিয়াক সমস্যা হলে সিসিইউতে পাঠানো হয়। আজিজুরকে কোথায় পাঠানো হবে, তা চিকিৎসকরা বোঝার আগেই তার ছেলে সাজিদ হাসান আইসিইউতে পাঠানোর কথা বলছিলেন বলে ওই চিকিৎসক জানান।
তিনি বলেন, “আইসিইউতে পাঠানোর পরে অনেক সময়ই রোগীর স্বজনরা আমাদের বলেন, কেন পাঠানো হলো? এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক আছে।
“আবার হাসপাতালের প্রটোকল অনুযায়ী আইসিইউর খরচটাও এখানে অনেক বড় ফ্যাক্টর। যার কারণে রোগীর স্বজনদের বলা হয়েছিল, খরচ সম্পর্কে জানার জন্য। নইলে পরে রোগীর স্বজনরা তা নিয়েও ঝামেলা করেন। এটা ম্যানেজমেন্ট থেকেই বলা আছে আমাদের। আমরা তো চিকিৎসক, হাসপাতালের নিয়ম তো আমরা বানাই না।”
এই চিকিৎসকের ভাষ্য অনুযায়ী, রোগীর ছেলেকে তখন বলা হয়েছিল, সঙ্গের অন্য স্বজনদের নিয়ে আইসিইউতে গিয়ে শয্যা ফাঁকা রয়েছে কি না, তা দেখে আসতে।
“তবে ডা. সজীব নজরুল এসময় রোগীকে দেখছিলেন। রোগীর অবস্থা খারাপ বিবেচনা করে আইসিইউর চিকিৎসকদের সঙ্গেও কথা বলছিলেন তিনি।”
রাত ৮টা ৪১ মিনিটে আজিজুরকে আইসিইউতে ঢোকানো হয়, হাসপাতালের নথিপত্রে তাই রয়েছে।
তখন তার সিপিআর বা কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি, যা জরুরি অবস্থায় হৃৎপিণ্ড এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পুনরুদ্ধারে দেওয়া হয়। এটি সাধারণত কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া) বা শ্বাসরোধজনিত পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়) চলছে।
আইসিইউতে নেওয়ার পর ২১ মিনিট পর এরপর ৯টা ২ মিনিটে আজিজুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ওই চিকিৎসক বলেন, রোগীর হাসপাতালে আসা, তাকে চিকিৎসকের দেখা, জরুরি বিভাগ থেকে তাকে আইসিইউতে নেওয়া, সব তো ‘ডকুমেন্টেড’। তা যে কোনও বিশেষজ্ঞ দেখলেই বুঝতে এখানে কোনও ধরনের গাফিলতি ছিল না।
মৃত্যুর পর
বাবার মৃত্যুর পর সাজিদ হাসান আইসিইউতেই চিকিৎসকদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ করেন হাসপাতালকর্মীরা।
তারা বলেন, আইসিইউতে থেকে বেরিয়ে জরুরি বিভাগে আসেন তিনি। এরপর তার ফোনে সেখানে জড়ো হয় এক দল তরুণ। তারা নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বলে পরিচয় দেয়।
আজিজুরের লাশ নিয়ে তার স্বজনরা সেই রাতেই চলে যায় দিনাজপুরে, সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
ওই রাতেই কলাবাগান থানায় রোগীর স্বজন পরিচয়ে মামলা করেন সুমন নামের একজন। সেখানে ডা. সজীব নজরুলকে এক নম্বর আসামি করে জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন, অর্থোপেডিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. আর আর কৈরি, অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ আরও ১৬ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, সঠিক সময় আইসিইউতে না নেওয়ার কারণে চিকিৎসা ব্যাহত হয়। যা চরম অবহেলা। তারা মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না।
সাজিদ হাসানও বলেন, চিকিৎসকরা তার বাবাকে আইসিইউতে নিতে দেরি করেছিল বলেই তার মৃত্যু হয়েছে।
“চিকিৎসকরা বলেন, আইসিইউতে কত টাকা লাগবে, সেটা জানতে। বাবা তো তাদের হাসপাতালের নিয়মিত রোগী ছিলেন, এর আগে দুবার এখানের আইসিইউতে ছিলেন। তারা কেন এটা জিজ্ঞেস করবে? তখন আমি চিকিৎসককে গালাগালি করি, আমার বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে এর পরিণতি ভালো হবে না বলেও জানাই।”
শিক্ষার্থীদের জড়ো করে চাপ প্রয়োগের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, “আমি, আমার স্ত্রী এবং স্ত্রীর ভাই সুমন তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমরা আসলে এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, ব্যক্তি কারও বিরুদ্ধে না।”
মামলাকারী সুমন বলেন, “সেদিন জরুরি বিভাগের নেওয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসা, ইসিজি পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর চিকিৎসক আমাদের বলেন, আইসিইউতে নিতে হবে, সেখানে গিয়ে খরচ জেনে আসার জন্য।
এনিয়ে সাজিদের সঙ্গে চিকিৎসকের বাক-বিতণ্ডা হয়, সাজিদ তাকে গালাগাল করে।”
সেদিন হাসপাতালে সমন্বয়কদের কেউ গিয়েছিলেন কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “সমন্বয়ক নয়, দুজন সহ সমন্বয়ক উপস্থিত ছিলেন।”
তারা কেন গিয়েছিলেন- প্রশ্নে সুমন বলেন, “তারা আমার ‘ক্লোজ ফ্রেন্ড’ হিসেবে গিয়েছিল। আপনি এখানে রাজনীতি টেনে আনবেন না।”
আসামি ১৭ থেকে ১
সুমন ১৬ ডিসেম্বর রাতে যে মামলা করেন, সেখানে ১৭ জনের নাম থাকলেও পরবর্তীকালে অন্যদের নাম কেটে দেওয়া হয়।
ইমার্জেন্সির চিকিৎসকসহ জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন, সৈয়দ আতিকুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক আর আর কৈরীর নামে কেন মামলা করলেন- প্রশ্নে সুমন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি আরেকটা মামলা করছি। এ মামলা কার্যকর নয়।”
১৭ জনকে আসামি করে করা মামলার অনুলিপি হাতে পাওয়ার কথা জানালে তিনি বলেন, “থানা থেকে তাহলে আপনাকে ‘ফলস কপি’ দেওয়া হয়েছে।”
১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে তিনি আর কোনও কথাই বলতে চাননি। তিনি বলছেন, মামলার আসামি কেবল ড. সজীব নজরুল।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, মামলা হওয়ার পর রোগীর স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটি আপস হয়েছে। সেই কারণে হাসপাতালের পরিচালকদের নাম বাদ দিয়ে এখন কেবল ডা. সজীবকে আসামি রাখা হয়েছে।
ডা. সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে নেওয়া হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার। তিনি জামিন চেয়েছিলেন, বিচারক সেই আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
সুমন জানালেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আলাদা করে আদালতে মামলা করা হবে।
“এটা আরও শক্ত গ্রাউন্ডে হবে, বেশি স্ট্রং হবে মামলা,” বলেন তিনি; কবে নাগাদ সেই মামলা হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সবই জানতে পারবেন।”
সুমন মিয়ার করা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কলাবাগান থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথমে বাদীপক্ষ না বুঝে ১৬ থেকে ১৭ জনের নামে এজাহার লেখে। কিন্তু হাসপাতালের অন্যদের তো এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল না বুঝতে পেরে নাম কেটে দেয়। হাসপাতালের লোকজন তো জড়িত না, তাই তারা (বাদী) কারেকশন করেছে পরে।”
সেদিন কী হয়েছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হাসপাতালে ঘটনার পর একের পর এক থানায় ফোন আসতে থাকে। বাদী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সবাই।”
হাসপাতাল থেকে কী বলেছিল- জানতে চাইলে ওসি বলে, “লোকজন ঝামেলা করছে। অনেক লোক এসেছে হাসপাতালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসেছে। তাদেরকে শান্ত করতে হবে। এরপর সেখানে টহল পুলিশ যায়। উপস্থিতদের শান্ত করা হইছে, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হইছে।
“হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল ভাঙচুরের আশঙ্কা করছিল আসলে। পুলিশ যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সবার সামনে বলা হয়, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ওই ডাক্তারের নামে মামলা করা হবে।”
এটা কে বলেছিল- জানতে চাইলে ওসি বলেন, “এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক)।”
এরপর সেদিনিই পুলিশ ডা. সজীব নজরুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে, পরে মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়।
আপনাদের সঙ্গে বাদী পক্ষের যোগাযোগ রয়েছে কি না- প্রশ্নে ওসি বলেন, “ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্তই শেষ।”
চিকিৎসকের পাশে নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
সহকর্মীকে কারাগারে যেতে হওয়ায় ক্ষুব্ধ গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎকরা। তারা এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দায় এড়ানোর অভিযোগও তুলেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিকিৎসক বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের বাঁচাতে ডা. সজীব নজরুলকে ‘বলি’ দিয়েছে।
এক চিকিৎসক বলেন, “আইসিইউতে নেওয়ার আগে যে প্রসিডিউরের কথা অর্থাৎ খরচের কথা বলা হয়েছে রোগীর স্বজনদের, সেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বানানো। চিকিৎসক বানায় না নিয়ম।
“জরুরি বিভাগের দায়িত্ব ছিল সজীব নজরুলের, সেখানে কোনও অবহেলার কথা তো কেউ বলছে না। তাহলে কেবল মাত্র তাকে প্রধান এবং একমাত্র আসামি করে মামলা কেন? প্রথমে হাসপাতালের চেয়ারম্যনসহ অন্যরা থাকলেও সেখান থেকে তাদের নাম কেন কেটে দেওয়া হলো?”
আরেক চিকিৎসক বলেন, “এত বড় ঘটনা, একজন চিকিৎসককে ধরে কারাগারে দেওয়া হলো। অথচ হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট আমাদেরকে কিছুই জানায়নি। ডা. সজীব এই হাসপাতালে ১২ বছরের মতো দায়িত্ব পালন করছেন, আমরা আমাদের সহকর্মীকে নিয়ে চিন্তিত। তার একটা সন্তান রয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের ইমেজ বাঁচাচ্ছে একজন চিকিৎসককে বলির পাঠা বানিয়ে।”
এ বিষয়ে কথা বলতে হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসান খালিদকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, “এ নিয়ে আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
পরে হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সোহরাব আলীকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কেবল চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা নিয়ে চিকিৎসকদের অসন্তোষ বহু দিনের।
চিকিৎসকদের অধিকার এবং সুরক্ষায় কাজ করে বাংলাদেশ ডক্টর্স ফাউন্ডেশন। এ সংগঠনের প্রশাসক ডা. নিরূপম দাশ বলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতেই চিকিৎসক গ্রেপ্তার নতুন কিছু নয়, যদিও এটা হওয়া উচিৎ নয়। ডা. সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তার করে তাকে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে। এর দায় দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও নিতে হবে।”
স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন কোথায়?
রোগীর মৃত্যুর পর চিকিৎসকের ওপর হামলা, হাসপাতাল ভাংচুর বাংলাদেশে অনিয়মিত ঘটনা নয়। মামলায় চিকিৎসক গ্রেপ্তারও দেখা যায়।
গত আগস্ট মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের মারধর ও ভাংচুরের পর তা ফের আলোচনায় আসে। প্রতিবাদে সারাদেশে চিকিৎসকরা ধর্মঘটও ডেকেছিল।
চিকিৎসকদের হেনস্তা, গ্রেপ্তার এবং হাসপাতাল ভাংচুর রোধের জন্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের দাবি দীর্ঘদিনের।
২০১৩ সালে এমন কয়েকটি ঘটনার পর চিকিৎসকরা কাজ বন্ধ করে দিলে একটি আইন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন নামে সেই আইনটির খসড়াও তৈরি হয়। কিন্তু আইনটি আর হয়নি।
নাসিমের পরের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আইনটি ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই বছরের শুরুতে সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনটি চূড়ান্ত করার বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় আবার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। গত ৩০ আগস্টে ফের এমন ঘটনা ঘটলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রতিবাদে ধর্মঘট ডেকে চিকিৎসকরা যে চারটি দাবি জানায়, তার মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কথাও ছিল।
তার আগে পেশায় চিকিৎসক সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল গত ১ মে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “ভুল চিকিৎসা বলার অধিকার কারও নেই, এমনকি আমারও। এটা বলার অধিকার আছে শুধু বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল)। এই ভুল চিকিৎসার অজুহাতে চিকিৎসকদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হয়, এটা খুবই ন্যক্কারজনক।”
“থানাতে অভিযোগ দিলেও চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়, এটা খুবই দূর্ভাগ্যজনক,” বলছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ এনিয়ে একটি কলামে লিখেছেন, “ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে করা উচিৎ। শুধু আবেগের বশে ভাংচুর বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ যেন না হয়।
“পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশের ডাক্তারেরও ভুল হয়। প্রয়োজনে মামলা হতেই পারে, কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই যেন গ্রেপ্তার ও হয়রানি না করা হয় এবং তাদের সঙ্গে খুনের মামলার আসামির মতো আচরণ কোনোক্রমেই কাম্য নয়।”
কারও বিরুদ্ধে চিকিৎসা সংক্রান্ত মামলা হলে গ্রেপ্তারের আগে বিএমডিসির অনুমতি নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন একুশে পদকজয়ী এই চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইনটির খসড়াটির কী অবস্থা জানতে চাইলে গত বছর স্বাস্থ্য সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ বলেছিলেন, “আইনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটা কেবিনেটে পাঠাব।”
কিন্তু সেই দ্রুততম সময় বছর শেষ হলেও আসেনি। বদল হয়েছে স্বাস্থ্যসচিবের। নতুন সচিব সাইদুর রহমানকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের দেখা সাংবাদিকরা পান না বলেই চলে। ফলে জানা যায়নি, আইনের খসড়াটি এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে।
সূত্র : সকাল সন্ধ্যা